এক মাসের বেশি সময় ধরে ডায়রিয়ার প্রকোপ ঊর্ধ্বমুখী
প্রতি বছর দেশে ডায়রিয়ার প্রকোপ শুরু হয় সাধারণত এপ্রিলের প্রথম দিকে। ছয় থেকে আট সপ্তাহ স্থায়ী হলেও পরে ধীরে ধীরে কমে আসে। কিন্তু এবার দেশে ডায়রিয়া প্রকোপ শুরু হয় বছরের প্রথম থেকেই। মার্চ মাসে এসে এটি ভয়াবহ রুপ নেয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ্ ইমার্জেন্সী অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্যানুযায়ি, জানুয়ারিতে সারাদেশে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন ১ লাখ ৫২ হাজার ৫১৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে একটু কমে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬৯ আর মার্চ মাসে ১ লাখ ৭০ হাজার ২৩৭ জন। আক্রান্ত হয়ে মারা যায় দুই জন।
মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর.বি) হাসপাতালে গত ৪২ দিনে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৪৩ হাজার ৪২৭ রোগী ভর্তি হয়েছে। হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো রোগীতে পরিপূর্ণ হওয়ায় দুটি বড় তাবু টানিয়ে সেবা দেওয়া হচ্ছে। তাতেও জায়গা সংকুলান হচ্ছে না।
বুধবার রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ১২ শয্যার বিপরীতে বর্তমানে ভর্তি আছে ২ শতাধিক রোগী। বেড না পেয়ে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের গাছতলাতেই চলছে ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসা।
আইসিডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ডায়রিয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে দূষণযুক্ত পানি। আরেকটি কারণ, এবারের দীর্ঘ খরা। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে, পানি কমতে থাকলে দূষণের মাত্রা আনুপাতিক হারে বেড়ে যায়। অত্যাধিক গরম পড়লে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই পানি বেশি খায়, আর দূষণযুক্ত পানি পান করলে ডায়রিয়া অনিবার্য।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ি চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ৮ বিভাগে আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখ ৬১ হাজার ৬১১ জন। এরমধ্যে সবোর্চ্চ ঢাকা বিভাগে ১ লাখ ৫৯ হাজার ২৪৭ জন। এরপর খুলনা ১ লাখ ১ হাজার ৮১৯, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫১ হাজার ৫৯৬, রাজশাহী ৩৭ হাজার ৬০৩, সিলেট ৩২ হাজার ৯৩৮, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩২ হাজার ১৮৬ জন, রংপুর বিভাগে ৩৪ হাজার ৮১৯ ও বরিশাল ১১ হাজার ৪০৩ আক্রান্ত হয়েছেন।
সবোর্চ্চ আক্রান্ত ৫ জেলার মধ্যে ঢাকায় জেলায় ২০ হাজার ৩৭৩, ঝিনাইদহ ১৭ হাজার ১০ জন, সিলেটে ১৬ হাজার ৯৮২, কুষ্টিয়া ১৬ হাজার ২৮২, চুয়াগাঙ্গা ১৫ হাজার ২০১ জন।
আইইডিসিআর'র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, সাধারণভাবেই প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে যে ডায়রিয়া হয় তার মধ্যে প্রধান কারণ কলেরা এবং ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া। এগুলো ছড়ানোর মাধ্যমই হচ্ছে এসব জীবাণু দ্বারা দূষিত পানি ও পচা বাসি খাবার।
তিনি বলেন, এই বছর গরম একটু আগেই শুরু হয়েছে। মার্চেই তাপমাত্রা উঠতে ৩৪, ৩৫ ডিগ্রিতে। এই ধরনের তাপমাত্রায় খাবারে দ্রুত জীবাণু জন্ম নেয়। কোন সময়ের পর আর খাবার খাওয়া উচিত না – সেটা মানুষ বুঝতে চায় না। এছাড়া ডায়রিয়ার জীবাণু ছড়ানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি মাধ্যম হচ্ছে পানি। ঢাকার যেসব এলাকা থেকে রোগী বেশি আসছে সেখানে কলের পানিতে সমস্যা রয়েছে। ঢাকায় পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মূলত উৎসে পানির মান পরীক্ষা করে। কিন্তু প্রচুর এলাকায় পানির পাইপ ফুটো হয়ে সুয়ারেজ লাইনের সাথে মিশে গেছে এবং এই সমস্যা সারা বছরের।
এদিকে দেশে চলমান ডায়রিয়া প্রকোপ মোকাবিলায় রাজধানীর ২৩ লাখ মানুষকে মুখে খাওয়ার কলেরা টিকা দেবে সরকার। গর্ভবতী নারী ছাড়া ১ বছর বয়স থেকে বড় সব বয়সের মানুষকে এ টিকা দেওয়া হবে। বুধবার চলমান ডায়রিয়া সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষ প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানানা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম।
তিনি বলেন, দুই ডোজের এই টিকা কর্মসূচির প্রথম ডোজ দেওয়া হবে মে মাসে। সবমিলিয়ে ২৩ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হবে। পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে জুনে। প্রথম ধাপে রাজধানীর পাঁচটি এলাকায় এই টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। সেগুলো হলো- যাত্রাবাড়ী, দক্ষিণখান, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, সবুজবাগ।
টিকা গ্রহণের প্রক্রিয়া কেমন হবে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা আরও বলেন, টিকা কার্যক্রমটি নিয়ে আমরা এখনও কাজ করছি। এই টিকা গ্রহণ করতে হলে আলাদা কোনো নিবন্ধনের প্রয়োজন নেই। নির্দিষ্ট তারিখ ও কেন্দ্র বাছাই হলে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে। নিকটস্থ কেন্দ্রে গেলেই টিকা নেওয়া যাবে।
সারা দেশে মোট ৪ হাজার ৫২৮টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। হাসপাতালগুলোতে ৫০০ মিলি ব্যাগ আইভি স্যালাইন মজুত আছে ৩ লাখ ৩০ হাজারটি, ১০০০ মিলি ব্যাগ আছে ৪ লাখ। এছাড়াও ১০০০ মিলি ব্যাগের আরও ১ লাখ ৬০ হাজার আইভি স্যালাইন শিগগিরই ক্রয় করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
ডায়রিয়া রোগীদের সুস্থ ব্যবস্থাপনার জন্য হাসপাতালগুলোতে অতিরিক্ত বিছানার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং ডায়রিয়া ওয়ার্ড চালু করা হচ্ছে। ডায়রিয়া রোগীদের চিকিৎসায় চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এরইমধ্যে ৬০ জনের বেশি চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
হাসপাতালের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ডায়রিয়া রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধ, আইভি স্যালাইন, মুখে খাওয়ার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ইত্যাদি চাহিদা অনুয়ায়ী পাঠানো হচ্ছে। সব বিভাগীর ভান্ডারে পর্যাপ্ত আইভি স্যালাইন মজুত করা হচ্ছে। একইসঙ্গে সব উপদ্রæত এলাকায় মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
ইউটিউবে এনবিএস-এর সব খবর দেখুন। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি: