দেশকে স্থায়ী মেরুকরণের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদীর সরকার ও শাসক দল। এমনই গুরুতর অভিযোগ তুললেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গান্ধী (Sonia-Modi)। অভিযোগের সপক্ষে দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে কংগ্রেস সুপ্রিমো বলেছেন, পোশাক, খাবার, বিশ্বাস, উৎসব বা ভাষা, যাই হোক না কেন, দেশবাসীকে দেশবাসীর বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে এবং বিরোধের শক্তিগুলিকে প্রকাশ্যে এবং গোপনে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
একটি সর্বভারতীয় ইংরাজি দৈনিকে সনিয়া আজ কলম ধরেছেন। নিবন্ধের শিরোনাম, ‘একটি ভাইরাস আমাদের গ্রাস করছে।’ তাতে দেশের চলতি পরিস্থিতির বর্ণনা করে তিনি বিভেদের রাজনীতির জন্য কাঠগড়ায় তুলেছেন কেন্দ্রের বর্তমান শাসকদের। নিশানা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে।
নিয়া লিখেছেন, বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রী অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু রূঢ় বাস্তব হল যে বহু শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা বৈচিত্র্যের উপাদানগুলিকে আমাদেরকে বিভক্ত করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাতে গিয়ে কংগ্রেস সভানেত্রী রবি ঠাকুরের (Rabindranath Tagore) আশ্রয় নিয়েছেন। বিশ্বকবিকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করে সনিয়া নিবন্ধের শেষে গীতাঞ্জলি থেকে উল্লেখ করেছেন কবির কালজয়ী লাইন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য…।’
সনিয়া দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গেও বিভেদের রাজনীতির বিপদের প্রসঙ্গ এনেছেন। বলেছেন, ধর্মান্ধতার ক্রমবর্ধমান পরিবেশ, ঘৃণা ও বিভেদের বিস্তার অর্থনৈতিক উন্নতির ভিতকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। এই প্রসঙ্গেই কর্ণাটকের চলতি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সামাজিক বিভাজনের ঘটনা নিয়ে নাম না করে শিল্পদ্যোগী কিরণ মজুমদার শ’র উদ্বেগের কথা উল্লেখ করেছেন কংগ্রেস সভানেত্রী। কর্ণাটকে হিজাব বিতর্ক, হিন্দুদের মেলায় মুসলিম ব্যবসায়ীদের স্টল দিতে আপত্তি তোলার মতো ঘটনাগুলির উল্লেখ করে শ’ বলেছিলেন, এইভাবে সামাজিক বিভাজন বিস্তার লাভ করলে শিল্প-বাণিজ্যেরও প্রভূত ক্ষতি হবে। এটা চলতে দেওয়া যায় না। এ জন্য তিনি হিন্দুত্ববাদীদের তীব্র আক্রমণের মুখে পড়েন।
বিগত কয়েক মাসে বিভিন্ন মঞ্চ থেকে ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসায় উস্কানি দেওয়ার একাধিক ঘটনা সামনে এসেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তরা সাধু সমাজের লোকজন। হরিদ্বারের একটি ধর্ম সংসদ থেকে মুসলিম নিধনের ডাক দেওয়া হয়। এই পরিস্থিতিকে ‘ঘৃণার ক্রমবর্ধমান কোরাস’ বলে আখ্যায়িত করে কংগ্রেস সভানেত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁর কথায়, বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে ভালো প্রতিবেশীসূলভ সম্পর্ক, শিল্পকলা, সিনেমা এবং দৈনন্দিন জীবনে বিশ্বাস ও বিশ্বাসের বিস্তৃত মিলন, যেগুলির হাজার হাজার বছরের দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে রয়েছে, যুগে যুগে আমাদের সমাজ সেগুলির জন্য গর্ব করে এসেছে, সেগুলি সংকীর্ণ রাজনৈতিক লাভের জন্য দুর্বল করা হচ্ছে। এরফলে ভারতীয় সমাজ ও জাতিসত্তার সম্পৃক্ততার ভিত্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।
সনিয়া লিখেছেন, ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা তাদের আদর্শের বিরোধী সকল ভিন্নমত ও মতামতকে নির্মমভাবে দমিয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে টার্গেট করে রাষ্ট্রযন্ত্রের পূর্ণ শক্তি তাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা যা প্রচার করে তা শুধুমাত্র মিথ্যা এবং বিষ হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। প্রতারণা এবং ভয় দেখানো এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এই পরিস্থিতিকে বলা চলে ‘সর্বাধিক শাসন’ অন্যদিকে ‘যৎকিঞ্চিৎ সুশাসন’।
প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করে সনিয়ার বক্তব্য, তিনি এর বিরুদ্ধে কিছু বলছেন না। এতে হিংসা, বিদ্বেষ ছড়ানোর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা এক ধরনের প্রশ্রয় পাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রীর রাজ্য গুজরাতের আইআইএম-আহমেদাবাদের একদল শিক্ষক ও ছাত্র মাস তিনেক আগে মোদীকে চিঠি পাঠিয়ে এই একই অভিযোগ করেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, প্রধানমন্ত্রী চুপ বলেই ঘৃণা ছড়ানোর কারবারীরা উৎসাহ পাচ্ছে।
সনিয়া লিখেছেন, ধর্মবিশ্বাসের অবমাননা যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। বিভাজনমূলক রাজনীতি শুধু কর্মক্ষেত্রেই নয়, প্রকৃতপক্ষে বাড়িতেও প্রবেশ করছে। দেশে এমন ঘৃণার পরিবেশ আগে ছিল না।
তাঁর কথায়, ঘৃণা, ধর্মান্ধতা, অসহিষ্ণুতা ও অসত্যের এক সর্বনাশ আজ আমাদের দেশকে গ্রাস করছে। আমরা যদি এখনই এটি বন্ধ না করি, তবে তা এমন ক্ষতিসাধন করবে যা মেরামতের অসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। এটা চলতে দেওয়া যায় না। তাঁর কথায়, ভুয়ো জাতীয়তাবাদের বেদীতে শান্তি ও বহুত্ববাদকে বলি দেওয়া হচ্ছে।
ইউটিউবে এনবিএস-এর সব খবর দেখুন। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেলটি: